দ্যুতির বিয়ে খেতে কলকাতা গেলাম। বৃহস্পতিবার আমি দিল্লি থেকে রিষড়া পৌঁছলাম, শুক্র রাতে অর্চিষ্মান ঢাকা থেকে নাকতলা ঢুকল। এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে বলল, শোনো, তুমি যদি কাল সকাল সকাল নাকতলা এসে যাও আমরা দুপুর দুপুর উপহার কিনে সন্ধে সন্ধে বিয়েবাড়ি চলে যেতে পারি।
অর্ধেক গিফট দিল্লিতে কেনা হয়েছে। বাকি অর্ধেক কোথা থেকে কেনা হবে সে নিয়ে কথা হয়েওছে, আবার হয়ওনি। অর্চিষ্মান আভাস দিয়েছে আমি যদি দিল্লি থেকে কিনে নিয়ে যাই তাহলেই বেস্ট হয়। আমি আভাস দিয়েছি ওয়ার্কশপ তো বিকেলেই শেষ হয়ে যাবে, তারপর যদি অর্চিষ্মান ঘুরতে ঘুরতে বাজারের দিকটায় যায়, অর্ধেক পূর্বপ্রজন্মের ভিটের ওমও নেওয়া যাবে, এই রাস্তা দিয়ে একসময় বুদ্ধদেব বসু হাঁটতেন ভেবে রোমাঞ্চিতও হওয়া হবে, তারপর রোমাঞ্চটোমাঞ্চ ফুরোলে টুক করে একটা দোকানে ঢুকে উপহার কিনে নিলেই সব দিক সুষ্ঠুভাবে রক্ষা পায়।
আভাস দেওয়াদেওয়ি ঘটেছে অর্চিষ্মান ঢাকা যাওয়ার আগে। আভাস যদি বিবাহের স্ট্র্যাটেজির তূণের একনম্বর ব্রহ্মাস্ত্র হয়, দু'নম্বর হচ্ছে সংযম। আভাস দিয়ে যদি থেমে যাওয়ার সংযম না দেখাতে পারা যায় তাহলে আভাস ধক হারায়। আমরা দু'জনেই সে সংযম দেখিয়েছি। মাঝখানের সাত দিন দু'পক্ষই নীরব থেকেছি। ঘাপটি মেরে থেকেছি কার পলক আগে পড়ে। বিয়ে বা জীবনের বাকি অনেক যুদ্ধই আসলে কার চোখের পলক আগে পড়বে-র রকমফের। স্রেফ অপেক্ষা দিয়ে কত প্রতিপক্ষকে যে কুপোকাত করা যায়।
*****
নাকতলার পথে উবারদাদা হিন্দি সিনেমার প্রেমের গান চালালেন। সব ষাটসত্তরের দশকের। একটা গান শুরু হতে বললেন, এটা আমার মিসেসের ফেভারিট গান, ম্যাডাম। গানটা আগে শুনিনি। পোস্টে লিখব বলে মনে করে রেখেছিলাম কিন্তু ভুলে গেছি। দ্বিতীয় হুগলী সেতু থেকে নেমে, চিড়িয়াখানা পেরোতেই দু’দিক দিয়ে শোঁ শোঁ করে তিনচারটে বাইক বেরিয়ে গেল। বাইকের পেছনের সিটে পেছন ফিরে বসে থাকা যুবকদের হাতে সিরিয়াস ক্যামেরা। সিগন্যাল এল, সিগন্যাল গেল। বাইকরা স্পিড বাড়িয়েকমিয়ে আমাদের ঘিরে ডি এন এ-র মতো এঁকেবেঁকে চলতে লাগল। উবারদাদাও স্পিড বাড়িয়েকমিয়ে বাইকদের গা ঘেঁষে চলতে লাগলেন। প্রায় দেড় কিলোমিটার অতিবাহিত হওয়ার একটা সাদা এস ইউ ভি হইহই করে আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ল, আমি সামনের সিট খামচে ধরলাম, এস ইউ ভি-র ড্রাইভারের পাশের জানালায় কনুই রেখে অর্ধেক বডি বার করে একটা লোক দাদাকে প্রচণ্ড ধমকে ওভারটেক করলেন। ঘটনার আকস্মিকতা ও তীব্রতায় আমি থতমত খেলাম। উবারদাদা রিয়ারভিউ মিররে চোখে চোখ রাখলেন।
কী হয়েছে বুঝলেন তো?
বোঝাই যাচ্ছে দাদা আমাকে জীবনে প্রথমবার দেখছেন।
শুটিং হচ্ছে। চেজ সিন। বন্ডের বইতে যেমন থাকে। বন্ড জানেন তো?
এটা জানি। দাদা কি বলতে চাইছেন কলকাতা শহরের বুকে কোনও বাঙালি বন্ডের চেজ সিনের শুটিং-এর মধ্যে আমরা পড়েছিলাম?
আমি তো বুঝেই স্পিড বাড়িয়েছি। বাইকগুলোর কাছাকাছি থাকছিলাম দেখছিলেন না। চিন্তা করবেন না, আমরা ক্যামেরায় এসে গেছি। আয়নায় দাদার দাঁত ফুটে উঠল।
প্যানিক থামাতে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে রিংকুপিসিকে হাই লিখলাম।
*****
সত্যনারায়ণ থেকে ডান দিকে ঢুকে এদিকওদিক বেঁকে মাঠ পেরিয়ে বাঁ, ডান, বাঁ, ফাইন্যাল ডানে বাঁক নিয়েই সাঁচিস্তুপ গেট এসে গেল। ফলকে 'মিত্র'। দোতলায় ডাইনিং টেবিল ঘিরে লোকজন বসে ছিল। ফাঁকা চেয়ারটায় বসলাম। বাবা ঢাকা দেওয়া বাটিটা আমার দিকে স্লাইড করলেন। এই নাও, কুন্তলা। আমি ঢাকনা তুলে চামচে করে রাবড়ি মুখে পুরলাম।
অর্চিষ্মান বলল, অত তরিবৎ করে খাওয়ার টাইম নেই কুন্তলা, বেরোতে হবে।
মা বললেন, তরিবৎ আবার কী? কথাটা তরিজুত। তরুজুতও অ্যালাউ করা যেতে পারে। ব্যস।
মাকে হাই ফাইভ দিলাম।
*****
অর্চিষ্মান ঢাকা থেকে উপহার কিনে এনে আমার ইচ্ছেপূরণ করল না, আমি দিল্লি থেকে খালি হাতে নাচতে নাচতে উপস্থিত হয়ে অর্চিষ্মানের ফ্যান্টাসি আনফুলফিলড রেখে দিলাম। বদলে এখন দুজনে কলকাতা থেকে উপহার কিনতে বেরোব। যে বলেছিল বিয়ে মানেই কম্প্রোমাইজ, তাকে নোবেল দেওয়া উচিত।
বিয়ে মানে সত্যিই কম্প্রোমাইজ। কখনও কখনও কম্প্রোমাইজের গুপ্তবেশে বর।
অর্চিষ্মানের সঙ্গে অটো চড়ে দিল্লির রাস্তায় টোটো কোম্পানি করি, সিনেমাহলে কনুইয়ে কনুই গলিয়ে বসি, কফিশপে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে গুজগুজাই - কিন্তু এ সবের থেকে আমার ভালো আর রোমাঞ্চকর লাগে শহরের রাস্তায় দু'জনে পাশাপাশি হাঁটতে। অবাধ্য অটো, বেপরোয়া বাস, গায়ে পড়া ভিড় বাঁচিয়ে দু'জনে হাঁটছি, কেউ তাকাচ্ছে না, পাত্তা দিচ্ছে না, দেবেই বা কেন কেউ জানেই না আমরা এক্সিস্ট করি। পৃথিবীর কাছে আমরা অদৃশ্য, আমাদের কাছে পৃথিবী।
ওয়েল, অর্চিষ্মানের মুখে কথা বসানোর দরকার নেই, আমার কাছে অদৃশ্য।
বাড়ি থেকে রিকশায় রামগড়। রামগড় থেকে অটোয় এইট বি। এইট বি থেকে অটোয় সাউথ সিটি শপিং মল। শপিং মলের সিঁড়ির নিচে ছাউনিতে গমগম স্টোভ, সসপ্যানে কানায় কানায় খলখল চা, চায়ে রুপোলি অ্যালুমিনিয়ামের মগ ডুবছে উঠছে, ডুবছে উঠছে।
আভাস বা অপেক্ষা - কোনওটারই দরকার নেই। যুদ্ধনীতির সম্পূর্ণ সমাপতন। সঙ্গী বন্দীর মুভ নিয়ে সব বন্দীই ডিলেমাহীন।
কাগজ না খুরি? খুরি। দশ না পাঁচ? পাঁচ। অর্চিষ্মান বলল, বিস্কুট খাবে? উঁহু। কিন্তু অন্য একটা জিনিস খাব। বিক্রেতার অনুমতি নিয়ে ঢাকনা খুলে একটা বাপুজি কেক বার করলাম। তুমিও খাও? অর্চিষ্মান মুখ ছ্যাতরালো। সবুজ কাগজ ছিঁড়ে কামড় দিলাম। ঠোঁটের এদিকে ওদিকে গুঁড়ো লেগে গেল। আমি হাসলাম, অর্চিষ্মান হতাশ মাথা নাড়ল।
আমিও মাথা নাড়লাম, তবে সুখে। এমন নয় যে অনেক বছর পর খাচ্ছি। রিষড়ায় ফ্রিজের ওপর ডজনখানেক রাখাই থাকে। দু'সপ্তাহে অন্ততঃ তিন বার, চায়ের সঙ্গে বাপুজি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারেন। বাড়ি গেলে আমিও ঘুরতেফিরতে খাই। আগেরবারও খেয়েছি। পরেরবার এসেও খাব।
দামি নয়, তুলতুলে নয়, কাজুকিসমিস আমন্ড আখরোটঠাসা নয়। বাপুজি কেক ফ্যান্সি নয়, ফ্যামিলিয়ার।
একটা ফ্যামিলিয়ার ছবি ভেসে ওঠে। পুরোনো বাড়ির রান্নাঘরের সাইডে পাতা ডাইনিং টেবিলে চেয়ারে বসে আমি চিকেনমটন সাঁটাচ্ছি, সমকৌণিক চেয়ারে মা দুঃখী বাটিতে দুধরুটি খাচ্ছেন।
দুঃখীটা খানিকটা অনুপ্রাস, খানিকটা আমার চিকেনমটনের উল্লাসকে আন্ডারলাইন করার জন্য। মায়ের জন্যও, অফ কোর্স, মাছমাংস ছিল, ইচ্ছে বা খিদের অভাবজনিত কারণে মা খাচ্ছিলেন না। দুঃখিত হয়ে তো খাচ্ছিলেনই না। আমার মা আগের জন্মে বেড়াল ছিলেন হাইলি। দুধ দেখলেই চোখমুখ চকচক করে উঠত।
সেদিনও মা সুখী সুখী মুখে দুধ এবং দুধের সঙ্গে নিমিত্তমাত্র কিছু একটা খাচ্ছিলেন, খেতে খেতে মায়ের সুখের আড়ালে একটা নির্দিষ্ট (এবং আমার হদ্দ ফ্যামিলিয়ার) ফিলিং জড়ো হয়ে উঠছিল। অবশেষে সংযম ভাঙল। খাবি সোনা? কী ভালো খেতে লাগছে। দেব একটু বাটিতে করে?
বাপুজি কেক খেতে খেতে এবং মুখ থেকে গুঁড়ো ঝেড়ে নিজেকে সভ্য শহরের যোগ্য রাখতে রাখতে আমার ভেতরেও একটা ফিলিং পাকিয়ে উঠল। চোদ্দই ডিসেম্বর বাঙালি শহরে ঘুরতে বেরিয়ে বাঙালি খুরিতে বাঙালি চা খাচ্ছি। পাশে বাঙালি বর। পিঠের রোদ্দুরটাও সামহাউ বাঙালি। জীবনে যে পঁচাত্তরটা আগুন দাউদাউ জ্বলছে একটাও নেভেনি কিন্তু এই মুহূর্তে একটার আঁচও গায়ে লাগছে না।
সব মিলিয়েমিশিয়ে একটা অসামান্য, অনির্বচনীয় সুখ আমাকে ছাপিয়ে উঠল। একটা দুশ্চিন্তাও। অর্চিষ্মানও কি এই সুখটা পাচ্ছে? পাওয়া উচিত কারণ শহর খুরি চা রোদ্দুর - সুখের এই সব এলিমেন্টই কমন। তিনটে ছাড়া। এক, ওর পাশে বরের বদলে বাঙালি বউ, ওর চায়ে চিনি, আর ওর নো বাপুজি কেক। প্রথম দুটো বদলানোর দরকার নেই বা না বদলালেই ভালো, তৃতীয়টার ব্যবস্থা সহজেই করা যায়।
যদিও একবার সেধেছি হয়তো আর একবার সাধিলেই খাইবে? প্রথমবার না বলে হয়তো মনে মনে আফসোসই করছে?
বললাম, কেকটা ভালো খেতে কিন্তু। একটা খাবে? অর্চিষ্মান নঞর্থক ঘাড় নাড়ল। আমি বললাম, আচ্ছা, গোটা না খাও, এই অর্ধেকটা টেস্ট করো, আমি আর খাব না।
অর্চিষ্মান বলল, হুগলী জেলার লোকেদের বাপুজি কেক ফেভারিট, তাই না?
চায়ের খুরি ডাস্টবিনে তাক করে ছুঁড়ে মলে ঢুকে গেলাম।
*****
আরও একটা ক্ষেত্রে আমাদের যুদ্ধনীতির সম্পূর্ণ সমাপতন ঘটে - তা হল শপিং। দুজনে বসে বসে নিজেদের গায়ে আস্তে আস্তে চিমটি কাটতে রাজি হব দ্যান দোকানে দোকানে ঘুরতে। অর্চিষ্মানের কেন খারাপ লাগে বলতে পারব না, আমার কথা বলতে পারি।
একদিক থেকে দেখলে খারাপ লাগার কিছু নেই কারণ শপিং করতে গিয়ে আমার এমন কিছু লোকের সঙ্গে দেখা হবে যাদের সঙ্গে আমার চাহিদাজোগানের সম্পর্ক। আমি চাইব, ওঁরা জোগাবেন কাজেই আমরা পরিপূরক। আবার অন্য দিক থেকে ঘোর অপরিপূরক কারণ আমি টাকা খরচ করতে চাইব না, ওঁরা আমার টাকা খরচ করাতে চাইবেন। আমি টাকা খরচ না করলে ওঁরা হতাশ হবেন, আমি একটা সস্তা শাড়ি কিনব বলে সাতটা দামি শাড়ি নামিয়ে দেখলেও হতাশ হবেন। যে ক'টা সপ্তাহ বাকি আছে জীবনের তাতে আমি আর কাউকে হতাশ করতে চাই না। আরও একটা ব্যাপার আছে। "বেচা" ব্যাপারটার মধ্যে আমি নিজে তো পড়তে চাইই না, কেউ পড়েছে দেখলেও আমার সেকেন্ড হ্যান্ড 'ধরণী দ্বিধা হও' ফিলিং হয়।
কিন্তু বেচতেও হয়, কিনতেও হয় - সাচ ইজ লাইফ। খারাপ লাগা এড়িয়ে জীবনের মধ্য দিয়ে চলা যায় না। যা করা যায় তা হল মিনিমাইজ। শপিং আমাদের কাছে মিনিমাইজেশন অনুশীলন। আমাদের অবজেকটিভ ফাংশান দোকানের দরজা দিয়ে ঢোকা এবং উদ্দিষ্ট বস্তু হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসার মাঝের সময়। আমাদের লক্ষ্য এই সময়টার মিনিমাইজেশন। বিবাহিত অবিবাহিত মিলিয়ে গত পনেরো বছরে আমরা এই এক্সারসাইজটিকে প্রায় পারফেকশনের পর্যায়ে নিয়ে গেছি।
প্রথম স্টেপ হচ্ছে লিস্ট বানানো। বাজারে যাব, গিয়ে দেখব কী পাওয়া যায়, তারপর দেখব কোন দোকানে সে জিনিস পাওয়া যায় - এই সব করলে হবে না। উবারে নির্দিষ্ট দোকানের ডেস্টিনেশন সেট করতে হবে, অটো থেকে নেমে গাল ফুলিয়ে দম নিয়ে দৌড়ে দোকানের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে, আমাদের উদ্দিষ্ট দ্রব্য দোকানের কোন তলার কোন শেলফে রাখা আছে জানা থাকলে দৌড়ে সে শেলফের সামনে উপস্থিত হতে হবে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস হাসাহাসি মিনিমাম রাখতে হবে, ইন্টারেস্টিং কিছু দেখলে চোখে চোখে একে অপরকে জানিয়ে রাখতে হবে - মনে রেখো, বেরিয়ে বিলাবিলা করব। শেলফের সামনে পৌঁছে দ্রব্য উল্টে স্টিকারের দাম দেখে, পোষালে ভেরি গুড বলে মূল্য চুকিয়ে প্যাক করিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। না পোষালে খোঁজ নিতে হবে এর থেকে সস্তা কিছু আছে কি না। কর্তৃপক্ষ হয় হ্যাঁ বলবেন, নয় না। 'হ্যাঁ' বললে ভেরি গুড বলে মূল্য চুকিয়ে প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে, 'না' বললে ভেরি গুড বলে। এতক্ষণের বন্ধ করে রাখা দম ফোঁস করে ছেড়ে, চা কফির আশায় এদিকওদিক তাকাতে হবে। চা কফি জুটিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে বলতে হবে, দোকানে লোকটাকে দেখলে? এরা কারা?
মলের দরজা দিয়ে ঢুকে বোর্ডে পুরুষালি বিভাগের পাশে আঁকা তীরচিহ্ন ফলো করে দোতলায় উঠলাম। কালো জামাপ্যান্ট পরা দেড়শো যুবক ঘিরে ধরলেন। কী চাই শোনার পর একশো ছেচল্লিশ জন পিছু হটলেন, বাকি চারজনের দুজন আমাদের আগে আগে, দুজন পেছন পেছন কাউন্টারের গোলকধাঁধা পেরিয়ে এঁকেবেঁকে চললেন। অদূরে, আমরা যে জিনিসটা কিনব ঠিক করেছি তার কাউন্টার। কাউন্টারে কালো পোশাকের যুবক অপেক্ষা করছেন। হাসি হাসি চোখ আমার চশমায় ফেভিকল দিয়ে সাঁটা।
যে বিপদটার আতংকে ছিলাম সেটাই ঘটল।
না, ভদ্রলোক আমার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বললেন। আগেও দেখেছি, আমাকে দেখে এমনকি সাউথ ক্যালকাটার শপিং মলের কর্মীরাও বাংলা বলে ওঠেন।
বলুন ম্যাম, কী দেখাব?
সেন্ট আছে?
অর্চিষ্মান আলতো গলা ঝাড়ল।
ও সরি, পারফিউম। আছে?
অফ কোর্স, ম্যাম। কী ধরণের দেখাব? অ দা কোলন ? অ দা পারফিউম? অ দা টয়লেট?
আর কেউ গলা ঝাড়ছে না। আমি বোকার মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। সেন্ট (বা পারফিউম, হোয়াটেভার) বলতে আমি দু'রকম বুঝি। এক রকম, যেটা মেখে কেউ ঘরের এ প্রান্তের দরজা দিয়ে ঢুকলে ও প্রান্তের লোককেও "কে রে ভাই" বলে ঘাড় ঘোরাতে হয়। দ্বিতীয় রকম হচ্ছে যেটা মেখে কেউ এ প্রান্তের দরজা দিয়ে ঢুকলে ও প্রান্তের লোক তো নিজের কাজ করে যেতেই পারে, এ দিকের লোকও, অস্বস্তিপ্রদ সন্নিকটে অগ্রসর না হলে সে গন্ধ পেতে অক্ষম হয়।
আমার এই দ্বিতীয় রকম সেন্ট পছন্দ। অর্চিষ্মান বলছে ওরও এক্স্যাক্টলি এই রকমের সেন্টই পছন্দ। সেন্ট, পারফিউম, অ দা কোলন। হোয়াটেভার।
ভদ্রলোকের ঠোঁট বাঁ দিকে প্রসারিত হল। অনেকটা হাসির মতোই। নো প্রবলেম। একটা কাগজের স্টিকে স্যাম্পল বোতল থেকে স্প্রে করে কাগজটা হাওয়ায় দু'বার নাড়িয়ে অর্চিষ্মানের দিকে এগিয়ে দিলেন।
এটা উডি।
অর্চিষ্মান শুঁকল। শুঁকে আমাকে কাগজটা হ্যান্ডওভার করল। আমি শুঁকলাম। ততক্ষণে ভদ্রলোক অন্য একটা কাগজের স্টিকে আর একটা স্যাম্পল স্প্রে করে অর্চিষ্মানের হাতে দিয়েছেন।
এটা মাস্কি।
অর্চিষ্মান শুঁকল। আমিও শুঁকলাম।
পরেরটা ফ্রুটি। তার পরেরটা ফ্রেশ। ক্রমে আমরা শুঁকলাম ক্রিস্প, ক্রিমি, জেস্টি, ভেলভেটি, স্মোকি, সিডাকটিভ, ক্রিমি, স্পাইসি, সুয়াভ, রোবাস্ট, রাগেড, পলিশড, ডিসটিংগুইশড, এলিগ্যান্ট ও ক্ল্যাসিক।
ভদ্রলোক অর্চিষ্মানকে বললেন, বলুন স্যার, কোনগুলো দেব? অর্চিষ্মান আমাকে বলল, কী গো, কোনটা নেবে?
হাঁ করলাম, আওয়াজ বেরোল না। কারণ ততক্ষণে আমার সারা শরীরে একটি প্রাচীন ট্রমা উন্মুক্ত হয়েছে।
(চলবে)
Comments
Post a Comment